ইরানি চুক্তি আবর্জনা ছাড়া আর কি?

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কলমের এক খোঁচায় ‘ইরান পারমাণবিক চুক্তি’ ওরফে ইরানি চুক্তি অবাঞ্ছিত কাগজে পরিণত হলো। এই চুক্তিটির জন্মগ্রহণের কাহিনি রয়েছে। সংক্ষেপে এরকম : জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়া), জার্মানি প্লাস ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইরান বারো বছর ধরে দিনের পর দিন মুখোমুখি বসে অজস্র অপ্রিয় কথাবার্তা বলে, আপস-মীমাংসায় উপনীত হয়। সংশ্লিষ্ট পার্টির সবাই সইসাবুদ করে, জাতিসংঘ সত্যায়ন করে সিল-ছাপ্পর দেয়। অবশেষে কূটনৈতিক টানাপড়েনের ও সংঘর্ষমূলক বিরুদ্ধতার অবসান ঘটিয়ে ২০১৫ সালে ঐতিহাসিক চুক্তিটির জন্ম হয়।

এই চুক্তিটির বিরুদ্ধে একটি নয়, দুটি দেশ খুবই নিরানন্দিত হয়—সৌদি আরব ও ইসরাইল। ইসরাইলি নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরাইলের ও সৌদিদের হয়ে সম্ভাব্য সব উপায়ে চুক্তিটিকে লাইনচ্যুত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। যেমন, ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণকালে কার্টুন বোমা দেখানো থেকে শুরু করে দেড়-দুই মাস পূর্বে (২০১৮ সালে) ইরানের ‘টপ সিক্রেট পারমাণবিক ফাইলপত্রে’র নাটকীয় প্রদর্শন। ইরানি চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের ‘গজ গজ’ আমরা নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের সময় থেকেই শুনে আসছিলাম।

প্রেসিডেন্টের কলমের খোঁচায় আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক চুক্তি থেকে সরে আসা যায় কি যায় না—এটা নিয়ে আলোচনা অবান্তর। তবে ট্রাম্প-প্রশাসন বৈশ্বিক কূটনীতির অলিখিত বিধি লঙ্ঘন করেছে, সেটা বলা অবান্তর নয়।

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি এজেন্সি ২০১৬ সাল থেকে এপর্যন্ত এগারোটি রিপোর্ট দাখিল করেছে, তাতে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হচ্ছে যে, ইরান তার হোমওয়ার্ক অক্ষরে অক্ষরে করে যাচ্ছে। কাজেই ইরানিদের সততা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে সেটি মূল্যহীন। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ঝুলিয়ে রাখা নিষেধাজ্ঞাগুলো তো বটেই, সঙ্গে বাড়তি কিছু কঠোরতর নিষেধাজ্ঞাও কিস্তিতে কিস্তিতে (ছয় মাসের মধ্যে) আরোপিত হবে। আর যারা ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রাখবে, তারাও নিষেধাজ্ঞার শিকার হবে।

ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ইরান কি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথ ধরবে? না। আয়াতুল্লাহ্ খামেনি একাধিকবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, ইরান এ পথে যাবে না এবং তার কথাই শেষ কথা।

প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির প্রশাসন ও হার্ডলাইনারদের মধ্যে নিশ্চয় অভ্যন্তরীণ বাকবিতণ্ডা চলবে/চলছে। অবশ্য এমন পরিস্থিতি যে ওয়াশিংটনের ‘গোলাপি স্বপ্ন’ তথা ’মোল্লাদের হটিয়ে’ ‘রেজিম চেঞ্জ’ ঘটাবে, তা-ও নয়। কারণ, ইরানিদের কাছে ‘ওয়াশিংটনের ওপরে আস্থা রাখা যায় না’ আবারো প্রমাণিত হলো। তদুপরি দেশের অর্থনীতিকে বহুমুখী অবয়ব দেওয়ার কর্মোদ্যম দৃশ্যমান।

বর্তমানে মাইনাস ট্রাম্প ইরানি চুক্তির অংশীদার দেশরা হলো : ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং ইইউ, চীন ও রাশিয়া। ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং ইইউ পরিষ্কার বলে দিয়েছে যে তারা ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে। অর্থাত্ চুক্তিটিকে ‘মরতে’ দেবে না। কার্যক্ষেত্রে এর অর্থ হলো, ইউরোপের ব্যাংকগুলোকে বাণিজ্যিক ম্যানেজমেন্ট পরিচালনার বিকল্প উপায় বের করতে হবে। ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যরত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে রক্ষা করতে ইইউ জটিল মেকানিজম তৈরির চেষ্টা করছে। এই ব্যবস্থাটি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে ইরানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে।

স্পষ্টত ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ মিত্রদের সত্যিকার অর্থেই বিপর্যস্ত অবস্থায় নিয়ে এসেছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রও অবিশ্বাস্যভাবে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ যে, ওয়াশিংটনের ‘কোম্পানি লাইন’ অমান্য করে ইইউ নিজের মতে স্বাধীনভাবে চলতে চাইছে। ফলস্বরূপ, ইরান ছাড়াও আরো কিছু ইস্যুকে নিয়ে আবারো ‘কথা’ উঠেছে, যার মধ্যে ‘নড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন রয়েছে। এই পাইপলাইন বসানো সমাপ্ত হলে জার্মানি ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে রুশ গ্যাস প্রবাহিত হবে। ইউরোপের অনেকগুলো কোম্পানি এই প্রজেক্টে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু ওয়াশিংটন চাইছে ইইউ মার্কিন এলএনজি কিনুন। এই অবাধ্যতার জন্য নিষেধাজ্ঞা এবং সন্ত্রাসেরও ভীতি রয়েছে। ইত্যবসরে যুদ্ধরাষ্ট্র মিত্র-অমিত্র নির্বিশেষে বাণিজ্য-যুদ্ধ শুরু করেছে। ট্রাম্প জার্মান গাড়ির ওপরে উচ্চহারের শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো যে রিটোরিক’কে বাস্তব অবয়ব দেওয়ার সঙ্গতি ইইউ’র কি আছে? যেমন : রুশদের এস-৪০০ মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনলে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিলেও তুরস্ককে টলানো যাচ্ছে না। কারণ তুর্কিদের জোর হলো যে পৃথিবী জুড়ে নানা ধরনের পার্টনারশিপ রয়েছে—রাশিয়া, চীন, ইরান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশ, সুদান ইত্যাদি। ফলে ইইউ তুরস্কের তুলনায় বড় হলেও তুর্কিদের মতো ভূ-রাজনৈতিক লিভারেজ ততোটা নেই। কারণ যারা পার্টনার হতে পারত ইইউ তাদেরকে মার্কিন পরিচালিত নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে এবং বিবিধভাবে অপমান ও চ্যালেঞ্জ করে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তদুপরি অভ্যন্তরীণভাবেও ইইউ বিভক্ত। ওয়াশিংটনের ওপরে জার্মানি, ফ্রান্স বা যুক্তরাজ্যের প্রভাব যে শূন্য তার জলজ্যান্ত প্রমাণ ইরানি চুক্তির আবর্জনায় পরিণত হওয়া। (এবং শুল্ক আরোপের তথা বাণিজ্য-যুদ্ধও)। বর্তমানে, ‘ইউরো-আটলান্টিক সম্পর্ককে বন্ধুসুলভ বলা যায় না, এবং পার্টনারশিপের ছিটেফোঁটাও আর নেই’ (ডার স্পিগেল, ১১.৫.১৮)।

বার্লিন, প্যারিস সর্বোচ্চ পর্যায়ে মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে একাধিকবার মিটিং করেছে বটে এবং রাশিয়া ও চীনের শত সমর্থন থাকলেও ইইউ’র তিনটি বড় দেশ ওয়াশিংটনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে বইকি। ইইউসহ বিশ্বের সব বন্ধুরাষ্ট্র এর আগে ওয়াশিংটনের পরিচালিত সব নিষেধাজ্ঞাযজ্ঞে মহা উত্সাহে অংশ নিয়েছে। আর এখন সেই বন্ধু দেশগুলোই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকি সামলাতে ব্যতিব্যস্ত। সঙ্গে গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া বাণিজ্যযুদ্ধ তো রয়েছেই।

ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের পরিণাম বিশাল। ওয়াশিংটনের এই কর্মকাণ্ডে করতালি দিয়ে বাহবা দিচ্ছে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। অন্যথা কৌশলগতভাবে ওয়াশিংটন পৃথক হয়ে পড়েছে। মার্কিন-উত্তর কোরিয়া মিটিংয়ে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে আস্থা রাখা যায় না’র ধূসরছায়া পিয়ংইয়ংয়ের উপলব্ধির ধারায় আনাগোনা করবে। বেইজিং এবং মস্কোরও অবশ্য এই অভিজ্ঞতা রয়েছে।

কিন্তু ইরানের কি হবে? প্রবহমান ইউরেশীয় ইনটেগরেশন প্রক্রিয়া, বাণিজ্য-বিনিয়োগ পার্টনারশিপের কেন্দ্র হিসাবে মস্কো, বেইজিং ও নিউদিল্লির সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে। এই তিন রাজধানী মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ভয়ে ভীত নয়, ফলে সামরিক ফ্রন্টে রুশরা অনায়াসে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম সরবরাহ করবে, চীন করবে ‘ক্যারিয়ার কিলারস’, রূপি/লিরা বা বার্টার সিস্টেমে ভারত ইরানিদের তেল কিনবে, চাবাহার বন্দর রবরবে ব্যস্ত হয়ে উঠবে, আরো কতো কি।

যুক্তরাষ্ট্রের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সবসময়ই ভূ-রাজনীতি চালিত। তাই দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় অন্যতম প্রধান শক্তি হিসাবে ইরানের আবির্ভাবকে ঠেকাতে হবে। জিবগনিউ বারজেজিনস্কি’র ‘দি গ্র্যান্ড চেসবোর্ড’-এ ফিরে আসতে হয়। বারজেজিনস্কি পই পই করে ‘চীন, রাশিয়া ও সম্ভবত ইরানসহ গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে সতর্ক করে গেছেন। এই কোয়ালিশন আইডিয়োলজি-ভিত্তিক নয় … এই ‘অ্যান্টি-হেজিমনিক’ কোয়ালিশনকে ব্যাহত করতে ইউরেশিয়ার পশ্চিমাংশের, পূর্বাংশের ও দক্ষিণাংশের বহিঃসীমা বরাবর যুক্তরাষ্ট্রের ভূকৌশলগত বিশেষ দক্ষতা থাকতে হবে, এবং থাকতে হবে যুগপত্ভাবে।’

ট্রাম্প কি ‘গ্র্যান্ড চেসবোর্ড বা দাবার বোর্ড’ পুনর্বিন্যাস করলেন মাত্র? তবে ইরানি অথবা পারস্যবাসিরাও দাবার চালের কিছু নিশ্চয় জানে।